শ্রী ভট্টাচার্য, কলকাতা: ভারত মহাসাগরের ১,২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বিশাল খাদ রয়েছে, যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অন্য যে কোনও স্থানের তুলনায় ৩৪৮ ফুট (১০৬ মিটার) কম (Paatal Lok Rasta)। এই খাদ ১৯৪৮ সালে ডাচ বিজ্ঞানী ফেলিক্স অ্যান্ড্রিস ভেনিং মেঙ্গে আবিষ্কার করেছিলেন। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এখানে খুব কম বলে এর নামকরণ করা হয়েছিল গ্র্যাভিটি হোল। এই গর্তটি ৩১ লক্ষ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এবং বিজ্ঞানীদের কাছে একটি ধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অবেশেষে মিলল সে ধাঁধার সমাধান।
গ্র্যাভিটি হোল কী?
গ্র্যাভিটি হোল হলো এমন একটি জায়গা যেখানে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম। ভারত মহাসাগরের এই মাধ্যাকর্ষণ গর্ত, যা ভারত মহাসাগর জিওয়েড লো (IOGL) নামেও পরিচিত, পৃথিবীর বৃহত্তম মাধ্যাকর্ষণ ব্যাহততার মধ্যে একটি। এর ফলে এই এলাকায় সমুদ্রের জল নেমে গিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এটিকে ‘পাতালে যাওয়ার রাস্তা’ও বলেন কারণ এটি দেখতে একটি গভীর গর্তের মতো।
৭৫ বছরের পুরনো রহস্যটি কী?
১৯৪৮ সালে এই গ্র্যাভিটি হোল বা মাধ্যাকর্ষণ গর্ত আবিষ্কারের পর থেকে, বিজ্ঞানীরা এর গঠনের কারণ খুঁজতে ব্যস্ত ছিলেন। এই রহস্য প্রায় ৭৫ বছর ধরে অমীমাংসিত ছিল, কিন্তু ২০২৩ সালে ভারতীয় বিজ্ঞানী দেবাঞ্জন পাল এবং আত্রেয়ী ঘোষ এর উৎপত্তি আবিষ্কার করেন। তার গবেষণাপত্রটি জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এই গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই মাধ্যাকর্ষণ গর্তটি ১৪০ মিলিয়ন বছর আগে তৈরি হয়েছিল এবং এর পিছনের কারণ ছিল একটি প্রাচীন সমুদ্র।
গবেষণা অনুসারে, টেথিস সাগরের ধ্বংসের কারণে ভারত মহাসাগরের মাধ্যাকর্ষণ গর্ত তৈরি হয়েছিল। টেথিস সাগর ছিল একটি প্রাচীন মহাসাগর যা মেসোজোয়িক যুগে গন্ডোয়ানা এবং লরাসিয়া মহাদেশের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে, গন্ডোয়ানা মহাদেশ ভেঙে যায়, যার মধ্যে আজকের আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, অ্যান্টার্কটিকা এবং ভারতীয় উপমহাদেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই ফাটলের প্রক্রিয়ায়, টেথিস সাগরের সমুদ্রতল পৃথিবীর ভূত্বকের নীচে ডুবে যায়।
আফ্রিকার ভারত!
ভারত একসময় আফ্রিকার অংশ ছিল, কিন্তু প্রায় ১৮০ মিলিয়ন বছর আগে, টেকটোনিক প্লেটের চলাচলের কারণে, এটি পৃথক হয়ে ইউরেশিয়ান প্লেটের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। এই সময়কালে, টেথিস সাগরের সমুদ্রতল ধীরে ধীরে পৃথিবীর আবরণের নীচে ডুবে যায়। এই প্রক্রিয়ায় ভারত মহাসাগর গঠিত হয়েছিল। টেথিস সাগরের তলদেশ ভারত মহাসাগরের নীচে চাপা পড়ে আছে এবং এর ধ্বংসাবশেষ থেকে গ্র্যাভিটি হোলের জন্ম হয়।
এরপর টেথিস সাগরের সমুদ্রতল যখন ম্যান্টলের নীচে চাপা পড়ে, তখন সেখানে উপস্থিত ম্যাগমা গলতে শুরু করে। এই গলিত ম্যাগমাটি কম ঘনত্বের ছিল, যা উপরের দিকে উঠেছিল। এই কারণে, এই এলাকার মোট ভর হ্রাস পেয়েছে, এবং মহাকর্ষীয় টানও দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে এই কারণেই মাধ্যাকর্ষণ গর্ত এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০৬ মিটার কমে গেছে। এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল প্রায় ১৪ কোটি বছর আগে।
আরও পড়ুন: এক-দুই নয়, এক্কেবারে চার দিক দিয়ে ঢুকে পড়ে ট্রেন! ভারতে ডায়মন্ড ক্রসিং কোথায় রয়েছে?
রহস্য উদঘাটন হল কীভাবে?
এই মাধ্যাকর্ষণ গর্তের উৎপত্তি বোঝার জন্য ভারতীয় বিজ্ঞানীরা ১৯টি কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করেছেন। এই মডেলগুলি গত ১৪০ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীর ম্যান্টেল এবং টেকটোনিক প্লেটের গতিবিধি অনুকরণ করেছে। এই সিমুলেশনটি দেখিয়েছে যে টেথিস মহাসাগরের ধ্বংসাবশেষ উত্তপ্ত, গলিত শিলাগুলিকে উপরে ঠেলে দিয়েছে, যার ফলে এই অঞ্চলে মাধ্যাকর্ষণ হ্রাস পেয়েছে। তবে, এই দাবিটি কেবল কম্পিউটার মডেলের উপর ভিত্তি করে, যার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
গন্ডোয়ানা ছিল একটি প্রাচীন মহাদেশ যা ১৮ কোটি বছর আগে ভেঙে গিয়েছিল। এই বিচ্ছেদের কারণে, ভারতীয় উপমহাদেশ আফ্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উত্তর দিকে সরে যায়। এই প্রক্রিয়ায় টেথিস সাগর ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং এর ধ্বংসাবশেষ ভারত মহাসাগরের নীচে চাপা পড়ে যায়। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে সমুদ্রের ভাঙন এবং ডুবে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াটি মাধ্যাকর্ষণ গর্ত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
বলে রাখি, ভারত মহাসাগর নিজেই একটি তরুণ মহাসাগর, যা প্রায় ৩ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে বর্তমান রূপ ধারণ করেছিল। এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মহাসাগর, যেখানে পৃথিবীর ২০ শতাংশ জল রয়েছে। কিন্তু গ্র্যাভিটি হোলের মতো অসঙ্গতিগুলি এটিকে আরও বিশেষ করে তোলে। এই এলাকাটি কেবল বিজ্ঞানীদের জন্যই উত্তেজনাপূর্ণ নয়, বরং এটি আমাদের পৃথিবীর ইতিহাস এবং গঠন বুঝতেও সাহায্য করে।
ভারত মহাসাগরের মাধ্যাকর্ষণ গর্তটি ১৪ কোটি বছর পুরনো হতে পারে, তবে এটি সম্পর্কে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে এই গবেষণা পৃথিবীর অমীমাংসিত রহস্য বোঝার দিকে একটি বড় পদক্ষেপ। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের পৃথিবী কতটা জটিল এবং রহস্যময়।