শ্রীজিতা ঘোষ, কলকাতা: তখন ঘড়ির কাঁটা থেমে দুপুর ১টা ৪৬-এ। আকাশে মেঘের চাদর, যদিও মুষলধারে বৃষ্টি নয়, কিন্তু বাতাসে ভেজার ছোঁয়া এতটাই প্রবল যে শরীর চুপচুপে। পুরুলিয়ার (Purulia) টামনা থানার অন্তর্গত তারা ড্যাম থেকে উপচে পড়া জল জোড়ে গিয়ে মিশছে এমন এক ২০ ফুট উঁচু জায়গায়, প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন মৎস্যপ্রেমী। জাল হাতে কেউ মাছ ধরছেন, তো কেউ ক্যামেরা তাক করে রাখছেন জলস্রোতের দিকে। প্রতি বর্ষাতেই এমন চিত্র দেখা যায় তারা ড্যামে। কিন্তু এবারের গল্পটা একেবারেই অন্যরকম।
চাঁদরাডি গ্রামের ‘সারপ্রাইজ’!
চাঁদরাডি গ্রামের বিকাশ গোপের জালে এদিন ধরা পড়ে এক অদ্ভুত আকৃতির মাছ। গা-ছমছমে শরীর, সরু ও লম্বা গঠন, চোখেমুখে যেন অচেনা এক আগ্রাসী চাহনি। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা — ‘এটা কী মাছ?’ কেউ বলেন সাপ, কেউবা বলেন বিদেশি প্রাণী! সোশাল মিডিয়ায় ছবি ছড়িয়ে পড়তেই বিষয়টি নজরে আসে মৎস্য দপ্তরের। বিশ্লেষণের পর দফতরের সহ-মৎস্য অধিকর্তা পিয়াল সর্দার জানান, ‘ছবি দেখে আমরা নিশ্চিত — এটি আমেরিকান ইল (Eel)। কিন্তু কীভাবে এটা এখানে এল, সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।‘
কোথা থেকে এল এই ‘ইল’?
আমেরিকান ইল (Anguilla rostrata) মূলত উত্তর আমেরিকার নদী ও সমুদ্রে পাওয়া যায়। এদের জীবনচক্র বেশ বিচিত্র — জন্ম হয় নোনা জলের সারগাসো সাগরে, সেখান থেকে লার্ভা ভেসে ভেসে মিষ্টি জলে পৌঁছে যায়। শৈশব ও যৌবন কেটে যায় মিঠে জলে, কিন্তু প্রজননের জন্য আবার ফিরে যায় সমুদ্রে। এই ইল অত্যন্ত সর্বভুক — ছোট মাছ, পোকামাকড়, জলজ প্রাণী সবই চলে এদের পেটে। নিশাচর হওয়ায় রাতে শিকার করে, এবং তাদের ঘ্রাণশক্তি এতটাই তীব্র যে অন্ধকারেও খাবার খুঁজে নিতে পারে।
কেন চিন্তিত বিজ্ঞানীরা?
বিশ্বজুড়ে আমেরিকান ইল-এর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন দেশে গবেষণা ও প্রকল্প চলছে। এমন একটি প্রজাতির আকস্মিক আবির্ভাব পুরুলিয়ার মতো জায়গায় প্রশ্ন তো তুলবেই। ভাবা হচ্ছে, কেউ হয়ত অ্যাকোয়ারিয়াম বা গবেষণার জন্য এনে পরে ছেড়ে দিয়েছে বা কোনও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লোড বা প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে ডিম বা লার্ভা এসেছে কিম্বা জলপ্রবাহের মাধ্যমে দূরদূরান্ত থেকে এসেছে, যদিও এটা হওয়ার সম্ভাবনা কম।
পরিবেশগত উদ্বেগ
বিদেশি প্রজাতি স্থানীয় মাছের খাদ্যচক্রে বাধা দিতে পারে। রোগ ছড়ানোর আশঙ্কাও অমূলক নয়। প্রশাসন এই ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছে। পুরুলিয়ার একটি জলাশয়ে এমন একটি মাছের ধরা পড়া শুধু শিকারি নয়, পরিবেশবিদদেরও কৌতূহলী করে তুলেছে। এটি কি নিছক কাকতালীয় ঘটনা, নাকি জলজ পরিবেশে কিছু বড় পরিবর্তনের আভাস? উত্তর পেতে আরও অনুসন্ধানের অপেক্ষা।