শ্রীজিতা ঘোষ, কলকাতা: ভারতের (India) সবচেয়ে বড় শত্রুর নাম নিয়ে কোনও দ্বিধা থাকার কথা নয়—পাকিস্তান (Pakistan)। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের (Partition of India) পর থেকে আজ অবধি, এই প্রতিবেশী রাষ্ট্র কাশ্মীর (Kashmir), সীমান্ত সন্ত্রাস ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত করে এসেছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে, এই পাকিস্তানের সঙ্গেই এখনও কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে ভারত (Dual Diplomacy India)। শুধু পাকিস্তান নয়, পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র তুরস্ক (Türkiye), এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হওয়া বাংলাদেশ (Bangladesh)—এই দেশগুলোর সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রয়েছে।
পাকিস্তান: সম্পর্ক তলানিতে, কিন্তু বাণিজ্য সচল
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বর্তমানে চরম উত্তেজনাপূর্ণ। সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি স্থগিত করা, সীমান্তে বারবার সংঘর্ষ, ও পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের জবাবে নয়াদিল্লি কড়া অবস্থান নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চেও ভারত পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশল নিয়েছে। কিন্তু তবুও, ভারত আজও পাকিস্তান থেকে রক সল্ট (সৈন্ধব লবণ), সুতির চাদর, চামড়া, রাসায়নিক দ্রব্য ও ড্রাই ফ্রুটস আমদানি করে। এই পণ্যগুলো মূলত ভারতীয় বাজারে সুলভ ও চাহিদাসম্পন্ন। পাকিস্তান থেকে এসব আমদানি করার অর্থনৈতিক যুক্তি রয়েছে।
বাংলাদেশ: মৈত্রীতে ফাটল, তবুও অর্থনৈতিক নির্ভরতা
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে উষ্ণ। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে সেই সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, বিশেষত পরবর্তী সরকারের সম্ভাব্য ভূমিকাকে ঘিরে, নয়াদিল্লির মধ্যে কিছুটা আশঙ্কা রয়েছে। তা সত্ত্বেও, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বস্ত্র শিল্পে একটি মিথোজীবী সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ভারত থেকে সুতো রফতানি হয়, বাংলাদেশে তৈরি হয় জামাকাপড়, যা আবার ভারতেই ফিরে আসে। এই পারস্পরিক নির্ভরতা দুই দেশের অর্থনীতিকে একে অপরের সঙ্গে জড়িত করে রেখেছে।
তুরস্ক: বন্ধুত্ব নয়, কিন্তু বাণিজ্যপূর্ণ যোগাযোগ
তুরস্ক পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে একাধিকবার সরব হয়েছে। রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতির সমালোচনা করে আসছেন। তবুও, ভারতের সঙ্গে তুরস্কের বাণিজ্য ক্রমেই বাড়ছে। ভারত তুরস্ক থেকে কার্পেট, মোজাইক ল্যাম্প, টাইলস ও মিনারেল অয়েল আমদানি করে। আর তুরস্কে ভারত ঔষধ, যানবাহন, যন্ত্রপাতি সহ নানা পণ্য রফতানি করে থাকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক বিরোধিতার মাঝেও অর্থনৈতিক স্বার্থে রয়ে গেছে চলমান বাণিজ্যিক সেতুবন্ধ।
তাহলে কেন চলছে শত্রুদের সঙ্গে বাণিজ্য?
এটাই আধুনিক কূটনীতির বাস্তবতা। একদিকে শত্রুতা ও ভূরাজনৈতিক বিরোধ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রয়োজন ও বাস্তবতা। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি আজ আবেগ নয়, বাস্তবতা নির্ভর। রাষ্ট্রের স্বার্থে, যেখানে অর্থনৈতিক সুযোগ থাকে, সেখানে সীমিত সম্পর্ক বজায় রাখা হয়। এটিকে শুধু ভারত নয়—বিশ্বের সব বড় অর্থনীতি অনুসরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ: নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিরোধিতার মাঝেও দুই দেশের মধ্যে শত শত বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চলে।
ভারত জানে, শক্তি প্রদর্শনের জন্য কূটনীতিতে স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র বলে কিছু নেই—আছে কেবল স্থায়ী স্বার্থ। তাই পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে কঠোর থেকেও সীমিত বাণিজ্য বন্ধ করেনি ভারত। তুরস্ক বা বাংলাদেশ—যারা কখনও কখনও বিরূপ আচরণ করেছে, তারাও ভারতের বাণিজ্যিক মানচিত্রে এখনো গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এই দ্বৈতনীতি ভারতীয় কূটনীতির দুর্বলতা নয়, বরং এক চৌকস বাস্তববাদী নীতি—যা পররাষ্ট্রনীতিকে স্থিতিশীল, নমনীয় ও লাভজনক রাখে।