ভুলে ভরা উচ্চ মাধ্যমিকের বাংলা বই! পাহাড় সমান অভিযোগে ঘনাল আশঙ্কার মেঘ

HS Bengali Textbook Errors

ভুলে ভরা উচ্চ মাধ্যমিকের বাংলা বই! পাহাড় সমান অভিযোগে ঘনাল আশঙ্কার মেঘ

Srijita Ghosh

Published on:

শ্রীজিতা ঘোষ, কলকাতা: ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পাঠ্যবইয়ে একাধিক তথ্যগত ভুল (HS Bengali Textbook Errors), সাহিত্যিক বিকৃতি এবং রচয়িতাদের পরিচয় গুলিয়ে ফেলার ঘটনা সামনে এসেছে। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের রচনার ভুল তথ্য উপস্থাপন, অনুপযুক্ত ভাষা ব্যবহার এবং গবেষণাহীন সম্পাদনা শিক্ষকমহলে গভীর অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে।

ভুল ও বিভ্রান্তির বিশদ তালিকা:

১. সুভাষ মুখোপাধ্যায় সংক্রান্ত ত্রুটি:

  • ‘কেন এল না’ কবিতাটি বাস্তবে ‘যত দূরেই যাই’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত হলেও পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ রয়েছে ‘পদাতিক’ গ্রন্থের।
  • কবির প্রাপ্ত ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিকে ‘ডি. লিট.’ সম্মানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষে একাডেমিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মানের মেলবন্ধনে বিভ্রান্তিকর।

২. জীবনানন্দ দাশ সংক্রান্ত অসঙ্গতি:

  • তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশের সঠিক সাল ১৯২৭, কিন্তু পাঠ্যবইয়ে লেখা হয়েছে ১৯২৮।
  • বলা হয়েছে, তিনি জীবদ্দশায় কোনও স্বীকৃতি পাননি — অথচ ‘বনলতা সেন’ গ্রন্থটি তাঁর জীবদ্দশাতেই বিপুল প্রশংসিত হয়েছিল।

৩. স্বামী বিবেকানন্দের চিঠির টিকা:

  • চিঠিতে বিবেকানন্দ চলিত ভাষার পক্ষ নিয়েছেন, অথচ টিকা লেখা হয়েছে আলঙ্কারিক সাধুভাষায়। এই অসামঞ্জস্য শিক্ষার্থীদের ভাবনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

৪. পাবলো নেরুদা ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়:

  • নেরুদার ‘তার সঙ্গে’ কবিতার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ ভাষাগতভাবে বিকৃত করা হয়েছে, মূল অনুবাদের সাহিত্যমান বিনষ্ট করে।

৫. সংকলন ও পত্রিকার বিভ্রান্তি:

  • কাব্যগ্রন্থ ও গল্প সংকলনকে পত্রিকার সংস্করণ বলা হয়েছে।
  • সম্পূর্ণ সংকলনকে একজন লেখকের একক সৃষ্টি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা সম্পাদনাশৈলীর জ্ঞানের অভাব প্রমাণ করে।

৬. প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বিষয়ে গুলিয়ে ফেলা:

  • ‘আদরিণী’ গল্পের লেখক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (মৃত্যু ১৯৩২) — অথচ তাঁকে রবীন্দ্র গবেষক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের সম্মান (দেশিকোত্তম, পদ্মভূষণ, রবীন্দ্র পুরস্কার) প্রদানকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
  • বাস্তবে এই সব সম্মান শুরু হয়েছে ১৯৫০-এর দশকের পর।

শিক্ষক মহলের প্রতিক্রিয়া:

  • তৃতীয় ও চতুর্থ সেমিস্টারের পাঠ্যবইয়ে বহু ভুল থাকার বিষয়টি প্রকাশ্যে এনেছেন শিক্ষকরা।
  • তাঁরা অবিলম্বে সংশোধনী নোট প্রকাশ, নতুন সংস্করণে সংশোধন এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সতর্কীকরণ বার্তা প্রকাশের দাবি তুলেছেন।

সংসদের অবস্থান:

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য জানিয়েছেন:

“কিছু ভুলের অভিযোগ পেয়েছি। বিস্তারিত রিপোর্ট নেওয়া হচ্ছে। আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি আছে। ভুল পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা সংশোধন করা হবে।”

সুপারিশ ও পরামর্শ:

  1. তথ্য যাচাই কমিটি গঠন করে প্রতিটি পাঠ্যবই প্রকাশের আগে প্রামাণ্য রিভিউ বাধ্যতামূলক করা হোক।
  2. বইয়ের টিকা, পরিচিতি ও ভাষা ব্যবহারে সামঞ্জস্য বিধান করা হোক।
  3. প্রসিদ্ধ অনুবাদ ও সাহিত্যিক রচনাকে বিকৃত না করে মূল রূপে উপস্থাপন নিশ্চিত হোক।
  4. শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি পাঠ্যবই সংশোধন উপদেষ্টা মণ্ডলী গঠন করা হোক।

এই ভুলগুলো শুধুমাত্র ‘ছোটখাটো’ তথ্যভ্রান্তি নয়, বরং বাংলা সাহিত্যের প্রতি অজ্ঞতা ও অবহেলার প্রকাশ। তাই শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব — এই বিষয়গুলি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করা এবং পাঠ্যবই নির্মাণে যথার্থতা ও নিষ্ঠার দাবি তোলা।

সঙ্গে থাকুন ➥