শ্রীজিতা ঘোষ, কলকাতা: মিড-ডে মিল (Midday Meal) নিয়ে নানা সময় নানা বিতর্ক আর অভিযোগে জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গের স্কুল ব্যবস্থা (West Bengal School)। তার মধ্যেই এক নতুন সিদ্ধান্ত ফের চাপে ফেলেছে শিক্ষক ও স্কুল প্রশাসনকে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র শিক্ষা মিশন এক নির্দেশিকায় জানিয়েছে, রাজ্যের প্রতিটি সরকারি স্কুলে স্থানীয় পথকুকুরদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে (West Bengal government latest guideline for Midday Meal)। এর জন্য দায়িত্ব নিতে হবে মিড-ডে মিল কর্মী ও পড়ুয়াদের।
কী আছে নির্দেশিকায়?
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলের বাইরে পথকুকুরদের খাবার দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি মিড-ডে মিল কর্মীদেরও তদারকির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পড়ুয়াদেরকেও এই কাজে যুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে তাদের মধ্যে পশুপ্রেম ও সহানুভূতি (Pet Care in School) তৈরি হয়। যদিও এই নির্দেশ আগে থেকেই রাজ্যের স্কুলগুলিতে জারি করা হয়েছিল। যাতে পড়ুয়াদের মধ্যে পশুপ্রেম বাড়ে তার ওপর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে এর বাস্তবায়ণ ঠিক কতটা করা যাবে তা ঘিরেও উঠছে প্রশ্ন।
শিক্ষক মহলের বক্তব্য
শিক্ষক সংগঠনগুলি সরাসরি এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা না করলেও স্পষ্ট করেছে, নির্দেশিকায় স্বচ্ছতারও অভাব রয়েছে। বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক, স্বপন মণ্ডল বলেন, ‘পথকুকুরদের খাওয়ানো মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এর জন্য বাজেট কোথা থেকে আসবে, তা নির্দেশিকায় নেই। মিড-ডে মিলের বাজেট থেকেই কি সেই খরচ চালানো হবে? সরকার আলাদা বরাদ্দ করবে? উত্তর নেই।’ যাদবপুর বিদ্যাপীঠ, প্রধান শিক্ষক, পার্থপ্রতিম বৈদ্য বলেছেন, ‘মিড-ডে মিলের খাবার কখনও কখনও বেঁচে যায়, সেগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কিন্তু প্রতিটি স্কুলে কতটি কুকুর খাবে, কারা হিসেব রাখবে! এসব বাস্তব সমস্যার সমাধান কোথায়?’
দায়িত্ববণ্টনে অস্পষ্টতা
শিক্ষকদের বক্তব্য অনুযায়ী, আগে থেকেই স্কুলে পঠনপাঠনের পাশাপাশি প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব, মিড-ডে মিল ব্যবস্থাপনা, রিপোর্টিং প্রভৃতি কাজে যথেষ্ট চাপ রয়েছে। তার মধ্যে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পথকুকুর খাওয়ানো, টিকাকরণ পর্যবেক্ষণ করা, এগুলো বাস্তবসম্মত নয়। শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক, কিঙ্কর অধিকারী জানান, ‘উদ্দেশ্য ভাল হলেও এটি মূলত সামাজিক দায়িত্ব। বিদ্যালয়কে এর কেন্দ্রস্থলে রাখা হলে, শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস পাবে। বিদ্যালয় ও শিক্ষকদের উপর এই বোঝা চাপিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ অনুচিত।’
মেনকা গান্ধীর আবেদন এবং প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া
এই উদ্যোগের পেছনে কেন্দ্রীয় পশুপ্রেমী নেত্রী মেনকা গান্ধীর (Maneka Gandhi) ভূমিকা রয়েছে। তিনি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রককে চিঠি দিয়ে পথকুকুরদের খাওয়ানো ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আবেদন জানান। তারই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র শিক্ষা মিশনের পক্ষ থেকে এই নির্দেশিকা জারি হয়।
সহানুভূতি ও সামাজিক শিক্ষা শিশুর চরিত্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার প্রয়োগ পরিকল্পনাহীন হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল কাজেই বিঘ্ন ঘটে। এই সিদ্ধান্তে মানবিকতার বার্তা থাকলেও, তার বাস্তব রূপায়ণের জন্য প্রয়োজন- স্বচ্ছ আর্থিক রূপরেখা, প্রশাসনের স্পষ্ট দায়িত্ববন্টন, বিদ্যালয়গুলিকে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক ও জনবল দিয়ে সহায়তা। আর তা না হলে শিক্ষকদের উপর অতিরিক্ত চাপ এবং মিড-ডে মিলের জটিলতা আরও বাড়বে। মানবিক উদ্যোগ যেন ব্যবস্থাপনার গলার কাঁটা না হয়ে দাঁড়ায়, সেটাই এখন দেখার।