নিউজশর্ট ডেস্কঃ রাত পোহালেই বাঙালির ঘরে ঘরে পূজিতা হবেন মা বিপত্তারিণী (Bipadtarini)। এই বিপত্তারিণী ব্রত পরেই সকলের হাতের কবজিতে দেখা যায় লাল রঙের তাগা বাধা আছে। হিন্দু ধর্মীদের মধ্যে এই রীতি লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে পাওয়া যায় একটিই উত্তর, তা হল এই লাল তাগার মাধ্যমে মা বিপত্তারিণীর আশীর্বাদে সকল বিপদ থেকে মুক্তির দিশা মিলবে। কিন্তু আদতে তা নয়, এর নেপথ্যে রয়েছে এক অজানা কাহিনী।
কেন পূজিতা হন মা বিপত্তারিণী?
দেবী দুর্গা হিন্দুধর্মের দেবী। দেবাদিদেব মহাদেবের অর্ধাঙ্গিনীর আদি শক্তি। অন্যান্য দেবী তাঁরই অবতার বা ভিন্ন রূপ। দেবী দুর্গার ১০৮ রূপের মধ্যে অন্যতম দেবী সঙ্কটনাশিনীর এক রূপ, দেবী বিপত্তারিণী। সঠিক অর্থে বিশ্লেষণ করলে ‘বিপত্তারিণী’ বা ‘বিপদনাশিনী’ দেবীর নাম নয়, উপাধি। যিনি বিপদ তারণ করেন, তিনিই বিপত্তারিণী।
কথিত আছে, শুম্ভ-নিশুম্ভ, অসুর ভ্রাতৃদ্বয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে দেবগণ একবার মহামায়ার স্তব করছেন, এমন সময় শিবজায়া পার্বতী সেখানে হাজির হয়ে শুধালেন, “তোমরা কার স্তব করছ গো?” যাঁর স্তব, তিনি স্বয়ংই এ প্রশ্ন করছেন। কিন্তু দেবতারা তাঁকে চিনতে পারলেন না। তখন পার্বতী নিজের স্বরূপ দেখিয়ে বললেন, “তোমরা আমারই স্তব করছ।” এর পরবর্তীতে দেবী শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করেন। দেবতাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। সেই থেকে মর্তবাসীর ঘরে ঘরে বিপত্তারিণী পুজোর সূচনা হয়।
আরও পড়ুনঃ আজব রহস্য! বিয়ের আগে পুরীর মন্দিরে গেলেই ভাঙা যায় কাপলদের প্রেম? কারণ জানলে অবাক হবেন
পুজোর রীতি
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ, তার মধ্যে একটি হল বিপত্তারিণীর ব্রত। প্রচলিত রীতি মনে, দেবী বিপত্তারিণীর ব্রত আষাঢ় মাসে রথ এবং উল্টোরথের মাঝে যে শনি এবং মঙ্গলবার পড়ে সেই দুই দিনেই পালিত হয়। বাংলায় ঘরে ঘরে বিবাহিত মহিলারা স্বামী-সন্তান-পরিবারের মঙ্গল কামনায় মা বিপত্তারিণী পুজো করেন। গ্রামাঞ্চলে বিপত্তারিণী পুজো চারদিন ধরে চলে। প্রথম দিনে দেবীর আরাধনা করা হয়। মহিলারা গঙ্গা বা কোনও নদীতে স্নান করে দণ্ডী কাটেন। তারপর দুই রাত্রি ধরে রাতে বাংলা লোকগান, ভজন ও কীর্তন চলে। চতুর্থ দিনে বিসর্জন হয়। বিপত্তারিণী পুজো উপলক্ষে মেয়েরা উপবাস করেন।
বিপত্তারিণী পুজোর শেষে সকলেই হাতে লাল তাগা বেঁধে দেওয়া হয়৷ মেয়েরা বাম হাতে ও ছেলেরা ডান হাতে এটি পরেন৷ এটি শুধু ব্রত পালন যিনি করছেন তিনিই যে বাঁধেন তা নয়, পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাঁধেন বিপদ মুক্তির জন্য৷ ব্রতপালনের পর খাবার যা খেতে হয়, সেখানেও ১৩ সংখ্যা রাখা আবশ্যক৷ মায়েরা প্রসাদ হিসেবে খান, তেরোটি লুচি বা পরোটা সঙ্গে তেরো রকমের ফল। চাল-চিঁড়ে-মুড়ি এসব খাওয়া যায় না৷ ফল বা ময়দার রান্না যাই খাওয়া হোক না কেন সেটা ১৩ সংখ্যায় গ্রহণ করার কথাই ব্রতে বলা হয়৷ তবে যদি সেটা না হয় তাহলে পুজো মিটে যাওয়ার পর বিজোড় সংখ্যাতেও খাদ্যগ্রহণ করা যায়৷
কেন হাতে বাঁধা হয় লাল তাগা?
শাস্ত্র মতে, বিপত্তারিণী পূজা ছাড়াও পূরাণে লাল সূতো ব্যবহার করার কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। পুরান অনুসারে, ভক্ত প্রহ্লাদের পুত্র বলিরাজ ব্রহ্মার আশীর্বাদে স্বর্গ, মর্ত ও পাতালের অধিকারী হয়েছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের সিংহাসন রক্ষা করতে ভগবান বিষ্ণু বামন রূপে জন্ম গ্রহণ করে বলিরাজকে পাতালে পাঠিয়ে দেন। ভগবান বিষ্ণু বলিকে অমরত্ব দান করলে, আর্শীবাদ স্বরূপ তিনি তাঁর হাতে বেঁধে দেন লাল সুতো। সেই থেকেই হিন্দুদের মধ্যে হাতে লাল সুতো বাঁধার প্রচলন রয়েছে।
এ ছাড়া পুরানে আরও একটা মত প্রচলিত আছে। এক সময় দেবতা ও অসুরের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। অসুরদের পরাক্রম দেখে দেবরাজ ইন্দ্র খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন। স্বামীকে চিন্তিত দেখে স্ত্রী ইন্দ্রাণী তাঁর জন্য প্রার্থনা শুরু করলেন। ইন্দ্রানী তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি একত্রিত করে লাল সুতো দিয়ে একটি সুতো তৈরী করেন। তারপর দেবরাজ ইন্দ্রের মঙ্গল কামনা করে সেই লাল সুতোর মালা তাঁর গলায় বেঁধে দেন। যাতে অসুরেরা তাঁকে আঘাত করতে না পারে। এরপর দেবতা ও অসুরের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। ইন্দ্রের নেতৃত্বে সেই যুদ্ধে দেবতারা জয়ী হন। তখন থেকেই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হিন্দুরা লাল সুতো বাধার প্রচলন করে আসছে।